শেখ নাহিদ নিয়াজী, মির্জা অদ্বিত রহমান, তপন মাহমুদ, মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম ও মো. হুমায়ূন কবির
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে শিক্ষক-কর্মকর্তা- কর্মচারীদের বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্চ মাসে ক্ষেত্রবিশেষে ৩৫ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন কর্তন করা হয়েছে, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক, অমানবিক ও অন্যায্য। এমনকি, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এপ্রিল ও মে মাসের বেতন ও ঈদ বোনাসও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সেসব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারের আর্থিক প্রণোদনার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে, কিন্তু তাদের এ আবেদন এখনো সরকারের সুনজরে পড়ার অপেক্ষায় আছে। অন্যদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের এই অর্থ সংকটের পেছনে শিক্ষার্থীদের কাছে থেকে গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টার-২০২০-এর টিউশন ফিস আদায় না করতে পারার অযৌক্তিক কারণ দেখাচ্ছে। উল্লেখ্য, গত ১৭ মার্চ, ২০২০ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করোনা মহামারীর প্রকোপ ঠেকাতে সাধারণ ছুটি চলমান আছে।
এটা বলা বাহুল্য, এই বৈশ্বিক মহামারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্থ ব্যবস্থাপনায় বিরূপ চাপ সৃষ্টি করেছে, যেহেতু প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের টিউশন ফিস হারাচ্ছে এবং তারা নতুন সেমিস্টারে শিক্ষার্থী ভর্তিও করতে পারছে না। এটা সত্য যে, বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীদের টিউশন ফি’র আয়ের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল; কিন্তু, এমন দুর্যোগপ্রবণ সময়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কর্তনের এই যুক্তি অবশ্যই অকাট্য নয়। ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ ২৫ বছরে এ খাতে অব্যবস্থাপনা ও আর্থিক অস্বচ্ছতার কারণ বিষয়ে আজকের এই লেখা। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের ভূমিকা আমাদের কাছে প্রশড়ববিদ্ধ।
উচ্চশিক্ষাবিষয়ক আমেরিকান গবেষক অধ্যাপক ফিলিপ জি আল্টব্যাক আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন
ক. গবেষণায় উৎকর্ষ, খ. উচ্চগুণমানসম্পনড়ব অধ্যাপক, গ. শিক্ষা ও গবেষণার অনুকূল পরিবেশ, ঘ. চাকরির নিশ্চয়তা এবং আকর্ষণীয় বেতন ও আর্থিক সুবিধা, ঙ. পর্যাপ্ত সুবিধাজনক উপকরণাদি, চ. পর্যাপ্ত গবেষণা তহবিল, ছ. শিক্ষায়তনিক স্বাধীনতা এবং জ্ঞানচর্চার বুদ্ধিবৃত্তিক অনুকূল পরিবেশ এবং জ. শিক্ষকমণ্ডলীর স্ব-শাসন।
এখন প্রশড়ব করাই যেতে পারে যে, আমাদের দেশের কতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় উপরোল্লিখিত মান অর্জন করতে সচেষ্ট হয়েছে? একটি উচ্চগুণগতমানসম্পনড়ব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে হলে নিমড়বলিখিত সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করা অত্যাবশ্যকীয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দুর্বল করে দিচ্ছে
১. অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য মহোদয়রা দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষায়তনিক এবং প্রশাসনিক নেতৃত্বস্থানীয় হওয়া সত্ত্বেও শোভাবর্ধক অলংকারস্বরূপ পদাসীন হয়ে আছেন। কারণ তারা স্বাধীনভাবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। উপাচার্যকে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ দ্বারা নিয়োগকৃত রেজিস্ট্রার এবং অন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দ্বারা একটা বলয় তৈরি করে আলাদা করে রাখা হয়।
২. বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণত অঙ্গ তিনটি শিক্ষার্থী, শিক্ষক আর প্রশাসন। বলাবাহুল্য, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অঙ্গ, যেখানে প্রশাসন হচ্ছে সহায়ক অঙ্গ। কিন্তু বাংলাদেশের বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতা ভিনড়ব। যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ফোকাল পয়েন্টে কখনোই রাখা হয় না অথচ প্রশাসনই সর্বেসর্বা। এর মূল কারণ প্রশাসনে সাধারণত নিয়োগ করা হয় ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যদের আত্মীয়স্বজন বা তাদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজন। আর প্রধান অঙ্গকে যখন অবশ করে সহযোগী অঙ্গ দিয়ে কাজ করা হয়, তার পরিণামই আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখছে।
৩. বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বার্ষিক আর্থিক বিবরণী (বার্ষিক বাজেট) শিক্ষক, ছাত্র কারও কাছেই উন্মুক্ত ও প্রকাশিত নয়। এমনকি তারা এটাও জানে না যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের কত অংশ আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থসংশ্লিষ্ট খাতে ব্যয় হচ্ছে। বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে বার্ষিক আর্থিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেয় না; এমনকি যা দেয় তার সত্যতা নিয়েও প্রশড়ব তোলার অবকাশ রয়েছে। এমনকি, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আইনসিদ্ধ অর্থ কমিটির নিয়মিত সভা করে না, যেখানে উপাচার্যও এই কমিটির একজন সদস্য। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, যিনি আচার্যও, কর্তৃক নিয়োজিত কোষাধ্যক্ষদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব জানানো হয় কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
৪. অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত বিধিবদ্ধ আইন বা চাকরি প্রবিধি, যেখানে চাকরির সুবিধাদি, নিয়োগ ও পদোনড়বতি নীতিমালা, অবসরের বয়সসীমাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদির উল্লেখ থাকার কথা তা প্রকাশিত নয়।
৫. অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রভাষক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করে, যা এই তরুণ শিক্ষকদের একটি অনিশ্চিত পেশাজীবনের দিকে ঠেলে দেয়, যেখানে তারা অনেকটা ভাসমান শিক্ষক হিসেবে স্থায়ী শিক্ষকদের উপভোগ্য অনেক সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত হন।
৬. কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবারতান্ত্রিক বোর্ড অব ট্রাস্টিজ রয়েছে, যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী আইনবহির্ভূত। এমনকি তারা আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষকেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিচ্ছেন বলেও আমাদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে না। এ ছাড়া, কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সম্মানিত সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাভজনক পদে আসীন থেকে নিয়মিত অফিস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ করেন এবং নিয়মিত মাসিক বেতন উত্তোলন করেন, যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী বেআইনি।
৭. অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আপৎকালীন সময়ে ব্যয়নির্বাহ করার জন্য কোনো ‘সংরক্ষিত তহবিল’ নেই; এমনকি তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপার্জিত অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের উনড়বয়নে পুরোপুরি ব্যয় করে না।
৮. অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত ও প্রকাশিত কোনো বেতন স্কেল নেই এবং তা নির্দিষ্ট সময় পরপর সংশোধন ও মানোনড়বয়নও করা হয় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বেতন স্কেল খুব গোপনীয় কোনো বিষয়, যা খুবই হাস্যকর। এমনকি, কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্টি সদস্যের আত্মীয় বা কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রাস্টি সদস্যের সঙ্গে যোগসাজশ করা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অস্বাভাবিক বেতন দেওয়া হয় বলে আমরা জানত পেরেছি, যাদের বেতন কোনো কোনো ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক বা ডিন মহোদয়ের চেয়েও বেশি থাকে। এরাই আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল তছরুপের সঙ্গে জড়িত থাকেন।
সম্প্রতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আর্থিক সংকট ও চাকরির অনিশ্চয়তার মধ্যেও অনলাইনে ক্লাস নিতে এবং শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে পরম আগ্রহী। এমতাবস্থায়, প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত তাদের সংরক্ষিত তহবিল থেকে ব্যয় নির্বাহ করে, তারপর সরকারের কাছে প্রণোদনা প্যাকেজের আশা করা। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এভাবেই সরকার তাদের এই আবেদনে ইতিবাচক সাড়া দেবে এবং এসব প্রতিষ্ঠানকে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করবে।
শিক্ষক সম্প্রদায় অত্যন্ত যুক্তিসংগত কারণে মনে করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এখনো অসম্পূর্ণ এবং অতিসত্বর পর্যালোচনার মাধ্যমে এর প্রয়োজনীয় সংশোধন আনয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। পরিশেষে, সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ পর্যালোচনার সময় নিমড়বলিখিত প্রস্তাবনাগুলো বিবেচনা করতে পারে
১. বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যদের মধ্যে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের মধ্য থেকে কমপক্ষে দুজনের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা ও ট্রাস্টি বোর্ডে একই পরিবারের দু-তিনজনের অধিক সদস্য না থাকার বিধান করা।
২. অর্থ কমিটিতে অন্যান্য সদস্য ছাড়াও কমপক্ষে দুজন শিক্ষক প্রতিনিধি রাখার বিধান করা, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী শিক্ষকদের মধ্য থেকে একজন শিক্ষক উপাচার্য কর্তৃক মনোনীত হবেন আর অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে প্রথিতযশা কোনো শিক্ষাবিদ মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক মনোনীত হবেন।
৩. শিক্ষক সম্প্রদায়ের সামষ্টিক স্বার্থরক্ষায় শিক্ষক সমিতি গঠন করার বিধান রাখা।
৪. বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধিমালা ও চাকরি নীতিমালা প্রণয়ন করে এবং শিক্ষকদের পেশাগত সুরক্ষা ও সুবিধাদি নিশ্চিত করে এমন ‘রক্ষাকবচ’ বিধান রাখা; যেমন কোনো শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধিত্ব রাখা, অংশীদারি ভবিষ্যৎ তহবিল, বৈশাখী ভাতা, গ্র্যাচুইটি/পেনশনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা উল্লেখপূর্বক একটি মডেল বেতন কাঠামো প্রস্তাব করা।
৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল তছরুপের ঘটনায় জড়িত এমন কোনো ব্যক্তিকে ট্রাস্টি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা শিক্ষক যেই হোন না কেন, অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় নিয়ে আসা।
৬. বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন শিক্ষাকার্যμমে ট্রাস্টি সদস্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপ রোধ করা এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বা কোনো ট্রাস্টি সদস্য যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো স্থায়ী শিক্ষায়তনিক বা লাভজনক পদে আসীন হতে না পারে সে বিধান অন্তর্ভুক্ত করা।
৭. প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় যেন কমপক্ষে ১০ কোটি টাকার সংরক্ষিত তহবিল বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তহবিল জমা রাখে তা নিশ্চিত করা।
৮. বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপার্জিত অর্থ যেন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের উনড়বয়নে ব্যয় হয় তা নিশ্চিতকল্পে বিধান রাখা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক বিবরণী (বার্ষিক বাজেট) প্রণয়নে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা এবং তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা।
লেখকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক